খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত নাজমুল সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার বারাত গ্রামের আব্দুল মালেক গাজীর ছেলে তার মাতার নাম রোকেয়া বেগম।
নাজমুলের সহপাঠী সূত্রে জানা যায়, দুর্গা পূজার ছুটিতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় নাজমুলের রুমমেটরা সবাই বাড়িতে চলে যায়। এর মধ্যে নাজমুল গত কয়েকদিন ধরে একা রুমে থাকতো। সে বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থতার মধ্যে ছিলো। প্রতিদিন সে ১২টি করে ট্যাবলেট সেবন করতো এবং সবসময় বিষণ্ণতা ও হতাশার মধ্যে থাকতো। প্রেশার, হাপাঁনি ও চোখের নানা রোগে আক্রান্ত ছিল বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ শুক্রবার সন্ধ্যায় নাজমুল ফোন করে তার বন্ধু নাদিমকে রুমে আসতে বলে। নাদিম নাজমুলের রুমে গিয়ে রুম ভেতর থেকে বন্ধ দেখতে পায়। কয়েকবার ডাকার পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে সে রুমের দরজা ধাক্কা দেয়ার একপর্যায়ে পাশের রুমের কয়েকজন শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে রুমের দরজা ভাঙার চেষ্টা করে পরবর্তীতে দরজা ভেঙে রুমে ঢুকে তারা সিলিংয়ে ঝুলন্ত নাজমুলের গলায় ফাঁস দেওয়া নিথর দেহ দেখতে পায়। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার পরে মেডিকেল সেন্টারে দায়িত্বরত ডাক্তার বদিউজ্জামান তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে মানসিক হতাশা থেকেই নাজমুল আত্মহত্যা করে।
এদিকে ক্যাম্পাসের সর্বত্র বিরাজ করছে শোকের ছায়া কেউ কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানাচ্ছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া, আত্নহত্যার বিষয়টিকে মেনে পারেননি ইবির বায়োটেকনোলজি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী, ইবি শাখা ছাত্র লীগের সাবেক সহ-সভাপতি বর্তমান ব্ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক সোহাগ।
তিনি সামাজিক মাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে লেখেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার মিছিলে যুক্ত হল আরেকটি নাম নাজমুল হোসেন (আইন বিভাগ সেশন ১৫-১৬,সাদ্দাম হোসেন হল রুম নং-২২৯)। আর কোনো নাজমুলের লাশ যেন ইবিকে সইতে না হয় তার জন্য অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে একজন করে সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট রাখার জোরালো দাবী জানাচ্ছি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ও ইবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম পলাশ দৈনিক অধিকার কে জানান, এই ধরনের অপমৃত্যু কখনওই কাম্য নয়। কিন্ত সাম্প্রতিককালে সারাবিশ্বে বিভিন্ন ভাবে আত্নহত্যার পরিমাণ দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। বাংলেদেশের প্রেক্ষাপটে এর কারণ হিসেবে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার, ঘরকুনো একাকিত্বকে দায়ি করেন।
তিনি বলেন, বর্তমান যুবসমাজ প্রযুক্তির প্রতি ঝুকে পড়ছে বহুলাংশে, তারা ঘরে বসে সবসময় ফেসবুক ও ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার খেলাধুলা ও সরাসরি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এর জন্য তারা বিশাল এই বিশ্বের বিশালতাকে বিন্দুমাত্র বোঝতে পারছেনা ফলেভ হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে ও আত্নহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তিনি যুবসমাজকে ইহা প্রতিরোধে খেলাধুলায় অংশগ্রহণসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহবান জানান।
ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ইবি মেডিকেলে অন্তত একজন দক্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এ বিষয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মনজুর হাসান বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে একজন করে সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট রাখার জোরালো দাবী জানাচ্ছি। সাপ্তাহে একদিন প্রত্যেক শিক্ষককে ৩ ঘন্টা কাউন্সিলিং এর উদ্যোগ নেবার দাবি জানান তিনি।
নাজিউর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম সাহেবকে আত্মহত্যা হত্যা হতে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ধর্মীয় জ্ঞান বা পরকালের ভয় না থাকলে এক হাজার মনোবিদ আনলেও কাজ হবে না।
রেজবী আহমেদ জনি বলেন, আত্মহত্যা সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে না, আত্মহত্যা বিষয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ইবি প্রশাসনের নিকট কাউন্সিলিংয়ের দাবি জানান। কেউ কেউ আবার শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
উল্লেখ্য, এ নিয়ে গত ৬ মাসে ইবিতে ৪জন শিক্ষার্থী আত্নহননের পথ বেছে নিলো। এ রকমভাবে আত্নহনণ কে বিশ্ববিদ্যালয় পরিরারের কেউই সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না।
এদিকে আইন বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব শুভ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আইন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নাজমুল হাসান (সাতক্ষীরা বাড়ি) কিছুক্ষণ আগে এসএইচ( সাদ্দাম হোসেন) হলে তার রুমে সুইসাইড করে মৃত্যবরণ করেছে। (ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন)। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। জানিনা আমরা ওর বাবা-মা কে কী জবাব দেবো? কেন এই দুঃসাহসীক আর মর্মান্তিক পথ বেছে নেয়া? কতটা আশা নিয়ে নাজমুল আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। হে আল্লাহ! তুমি নাজমুলের পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দিও। আমিন।
ইবির আইন বিভাগে সাবেক শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল ইসলাম তার ফেসবুক ওয়ালে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, একেকটি আত্মহত্যা থেকে আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না। সমাধানের পথ খুঁজছি না, ফলে কিছুদিন পর পর আত্মহত্যার সংখ্যা কেবলই বেড়ে চলেছে। রোগের নিরাময়ের জন্য আমরা যতটা চিন্তিত মনের নিরাময়ের জন্য ততটাই উদাসীন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৩টি বিভাগে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। স্বাভাবিক রোগের জন্য একটি মেডিকেল সেন্টার থাকলেও শিক্ষার্থীদের মানসিক রোগের জন্য কোনো ব্যবস্থা ইবিতে নেই!
১৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কাউন্সিলিং সেন্টার নেই! একটা শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে হতাশ হতে পারে। অ্যাকাডেমিক ফল, প্রেম, অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি। একজন শিক্ষার্থী তার হতাশার কারণটা কার কাছে বলবে? একজন শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে সীমাবদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক আছেনন যারা শ্রেণি কক্ষের বাইরেও শিক্ষার্থীকে সময় দেয়, তাদের বিভিন্ন ব্যাপারে সহায়তা করে।
কিন্তু বিরাট একটি অংশ কেবলই শ্রেণি কক্ষে সীমাবদ্ধ। এমনটাও আছে ১ম, ২য়, ৩য় বর্ষে অনেক স্যারের রুমের সামনে পর্যন্ত যাওয়া যায় না, কথা বলার সুযোগ সে তো আকাশ কুসুম কল্পনা। তাহলে একজন হতাশ শিক্ষার্থী তার কথাগুলি কাকে বলবে? কে তাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখাবে?
প্রতিটি আত্মহত্যার পিছনের কারণ অনুসন্ধানে আমরা যতোটা সময় ব্যয় করি এই সময়টাই যদি একজন হতাশ শিক্ষার্থীকে দিতাম, যদি তার মানসিক উন্নয়নে কাউন্সিলিং করানোর ব্যবস্থা থাকতো তাহলে হয় তো আত্মহত্যা ব্যাপারটি শুনতে হতো না।
দুদিন পর নাজমুলের হাসি মাখা মুখ ১৭৫ একর ভুলে যাবে আবারও হয় তো আরেকজন এমন ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেবে কিন্তু সমাধানের পথ নিয়ে আমরা কি মৌনতায় পালন করতে থাকবো? ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর একটি বিরাট অংশ বিভিন্ন কারণে হতাশ। কেউ হতাশ হয়ে মাদক নিচ্ছে, কেউ পড়াশোনা ছেড়ে রেকলেস জীবন যাপন করছে।
সব শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নয়নে যদি আমরা এতো উদাসীন হই আদৌ কি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব হবে? আশাকরি আত্মহত্যা রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে এবার সবাই ভাববেন। প্লিজ আর কোনো মূল্যবান জীবন ঝরে যেতে দিয়েন না প্লিজ প্লিজ।
আইন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আবির তার ফেসবুকে লেখেন, ইবি’তে এক বছরে এ নিয়ে চার জন আত্নহত্যা করলো, সবগুলোই প্রায় প্রেমঘটিত কারণে। এ চার জন ব্যক্তি ২০১৮ সালে ইবির ইতিহাসে একটি কলঙ্কনীয় অধ্যায়ের সূচনা করল। কী দরকার ছিলো এ সবের? কেনই বা আত্নহত্যা করতে হবে? প্রেমিক প্রেমিকা ছাড়া কি আপনাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই?
আপনি তো মরলেন কিন্তু মরার আগে তো একবারো ভাবলেন না যে আপনার বাবা মায়ের কী হবে যারা আপনাকে এতদিন কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করেছে? কখনো কি ভেবেছেন আপনার ফ্রেন্ড সার্কেলের কি হবে যারা আপনার চলার সাথী এবং আপনাকে অনেক ভালোবাসে?
কখনো কি ভেবেছেন যে আপনার অগোচরেই হয়তো কেউ আপনাকে অনেক ভালোবাসে? তা ভাববেন কেন! আপনি তো আপনার জীবনের মূল্যই বোঝেন না এবং আপনাকে যারা ভালোবাসে তাদের ভালোবাসার দাম নেই আপনার কাছে, আপনি তো শুধু আপনার প্রেমিক/প্রেমিকাকেই সবচেয়ে দামী বস্তু মনে করেন যার কাছে আপনার কোনো মূল্য নেই।
আর হ্যা আপনারা তো মারা যান সাথে করে আমাদের কেও শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যান। সত্যিই খুব খারাপ লাগে যখন শুনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোনো ভাই/বোন আত্নহত্যা করে। এখন আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি যেনো আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করে দেন। (সংগৃহীত)
ইবির আইসিই জসিম উদ্দিন তার ফেসবুকে লিখেছেন, আদর্শের ভিত্তি গড়ে ওঠে তার পরিবার থেকে এবং তা পরিমার্জন ও পরিবর্ধণের দায়িত্ব থাকে শিক্ষকের। একজন শিক্ষক হতে পারে সবচেয়ে বড় মোটিভেটর, কারণ অস্বাভাবিক কেউ ডাক্তারের যেতে না চাইলেও ক্লাসে ঠিকই যায়। একজন শিক্ষক যদি ভাবেন সিলেবাসের টপিক্স শেষ করায় আপনার কাজ, তাহলে স্যার আপনি কষ্ট করে ক্লাসে আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রটি অটুকু পড়ে নিতে পারবে।
শ্রদ্ধ্যেয় শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত ক্যাম্পাসে আসুন, ক্লাসের বাহিরেও ছাত্রছাত্রীদের সাথে তাদের জীবনাচরণ নিয়ে আলাপ করুন। শুধু সিলেবাস শেষ করার জন্য নির্ধারিত সময়ে ক্যাম্পাসে আসবেন, তারপর বাড়ির বাস ধরবেন, সপ্তাহে দু’তিনদিন আসবেন, তাহলে আপনি কোন স্যার? ছাত্রছাত্রীদের সাথে বসেন, গল্প করেন, অভিজ্ঞতা শেয়ার করে এদের জীবন গড়া ও জ্ঞান সমৃদ্ধিতে সহায়তা করুন। আত্মহত্যা মোটেও কাম্য নয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যা প্রবণতা ভয়ানক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশার জায়গাগুলো ঘসে মেজে দিই।
বাবা মা ক্যাম্পাসে পাঠিয়েছেনে শিক্ষক, বন্ধু, সহপাঠী এরাই তোমার পরিবারের সদস্য। এদের সাথে শেয়ার করো, আত্মহত্যা করা কাপুরুষতা, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না, হয়ও না। আল্লাহর রহমতে আইসিই বিভাগ থেকে কেউ আজো আত্মহত্যা করেনি, ইনশাআল্লাহ করবেও না।
Comments are closed.
Facebook Comments